Magic Lanthon

               

মাহমুদুল হাসান

প্রকাশিত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

অফসাইড : ‘নিপীড়নের বৃত্ত’ ভেঙে বেরিয়ে আসা ‘নিষিদ্ধ’ নারী

মাহমুদুল হাসান


গৌরচন্দ্রিকা

...

মেঘনা পদ্মা কর্ণফুলী যেই নামে ডাক

পুরোপুরি পাল্টে গেছে জলের শরীর;

এই নদী সেই নদী নয়

খরধার বেগবান তরঙ্গিত গতি

সহিংস আঘাতে খায় সাবেক বসতি।

খরস্রোতা নদী যেমন সহিংস আঘাতে বসতির অস্তিত্ব বিলীন করে, তেমনি রাষ্ট্রকেও অনুরূপ চরিত্রে আবিষ্কার করা অসম্ভব নয়। রাষ্ট্ররূপ নদীর কড়াল গ্রাসের শিকার তারই দুই ধারে বসতি গড়া মানুষগুলো। আর সেখানে মানুষ হিসেবে নারীর অবস্থান তো আরো প্রান্তিক। কাজেই নারীকে প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর করে দমিয়ে রাখাতেই যেনো রাষ্ট্রের শান্তি। আবার এ কাজটা গিয়ে যেনো বর্তেছে পুরুষের ঘাড়েই। কারণটা তাদের অজানা নয়। নারীকে বন্দি করতে না পারলে পুরুষের অস্তিত্ব সঙ্কটের যে ভয়, সেই ভয় থেকেই পুরুষ নারীর ওপর প্রভুত্ব করবার চেষ্টা চালায়। আর এ কাজে পুরুষের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে রাষ্ট্র। তাই হয়তো নারীর কাছে রাষ্ট্র আর পুরুষ কর্তৃত্ব একই বলয়ে আবদ্ধ থাকে, আর সেই বলয় থেকে ছিটকে পড়ে নারী। এই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বা বজায় রাখবার ক্ষেত্রে পুরুষ কিংবা পুরুষ প্রাধান্যশীল রাষ্ট্রের এক অমোঘ অস্ত্র হলো ধর্ম। ধর্মের ভূয়া সাফাই গেয়ে চলে নারীকে বন্দি করে রাখবার মহাযজ্ঞ। ধর্ম কি আদৌ নারীকে বন্দি করে রাখবার কথা বলে নাকি ‘মুক্তির? প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্নগুলো এমনজ্জ

আমি যখন প্রশ্ন করি কোরআন পিতৃতন্ত্র বা নারী-বিদ্বেষী গ্রন্থ কিনা, তখন আমি জিজ্ঞেস করছি এটি কি ঈশ্বরকে পিতা/পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিংবা ঈশ্বরের সাথে পুরুষের বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে শিক্ষা দেয়, বা পুরুষদের রয়েছে ঐশ্বরিক গুণাবলী আর নারীরা স্বভাবজাতভাবে দুর্বল, অশুচি, বা গুনাহগার ...। উপরন্তু, পিতা/স্বামীর শাসন ঐশ্বরিকভাবে নির্দেশিত, পৃথিবীতে ঈশ্বরের শাসন বহাল রাখার উপায় এটিই, [কোরআন কি] তাই শেখায় যা ধর্মীয় এবং সনাতনী পিতৃতন্ত্র দাবি করে? যদিও মুসলমান নারী ধর্মগ্রন্থের নিপীড়নমূলক অপ-পাঠের ফলাফল সরাসরি ভোগ করেন, অল্পজনাই তার বৈধতা প্রশ্ন করে, আর আরো অল্পজনাই কোরআনের শিক্ষার মুক্তিকামী দিক অনুসন্ধান করেন। ...কারণ অনেকেই কোরআন পড়েননি, বা সেটির পিতৃতান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু, অনেক পণ্ডিতের মতে, অসমতা এবং প্রভেদকরণ কোরআনের শিক্ষা থেকে উৎসারিত না, বরং আনুষঙ্গিক ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে, যথা, তাফসির এবং আল-হাদিস ...।

কাজেই ‘ধর্মীয় এবং সনাতনী পিতৃতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে বা সেই বন্দিদশা থেকে ‘মুক্তির আশায় নারী প্রতিবাদ করলেই পুরুষ বা পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজ-রাষ্ট্র খড়গহস্ত হয়ে ওঠে নারীর ওপর। অবরুদ্ধ করতে চায় নারীকে। তবুও সহস্র খড়গ উপেক্ষা করে নারী এগিয়ে চলে সামনের দিকে, ‘মুক্তির দিকে। ইরানি নির্মাতা জাফর পানাহির চলচ্চিত্র অফসাইড (২০০৬) যেনো সে কথাই বলে যায় আলগোছে। ইরানে নারীরা মাঠে খেলা দেখতে যেতে পারে না। রাষ্ট্রীয় এবং ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা জারি থাকা সত্ত্বেও একদল নারী খেলা দেখতে ঢুকে পড়ে স্টেডিয়ামে। ফুটবল খেলায় যেমন প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে বল ছাড়া ঢুকে পড়লে বা বল পাস দেওয়ার আগে ঢুকলে অফসাইড হয়-অনেকটা তেমনই। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই, ভিন্নভাবে বললে ‘ক্ষমতা ছাড়াই, যখন পুরুষ প্রাধান্যশীল রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিরক্ষাবলয়ে নারী ঢুকে পড়ে, তখন তো ‘অফসাইড অবধারিত। রাষ্ট্রও সেটাকে ‘অফসাইড বলেই পরিগণিত করে। কিন্তু পানাহি বাঁশি ফুঁকে জানান দেন আদৌ ‘অফসাইডটা হলো কি না, হলেও সেটা কার?

গল্পের পেছনে গল্প : ‘কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই

আগেই বলেছি, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের নারীরা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অনুমতি পায় না; আর এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ সেন্সরবোর্ড-এর অনুমতি পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পানাহি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন এবং এই বিষয়টি নিয়েই; কারণ এর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে খোদ তার মেয়ে সোলমাজ পানাহি!

সময়টা ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ। সোলমাজের বয়স তখন ১০ কি ১১ বছর। সে বাবার পিছু ধরে; স্টেডিয়ামে সে যাবেই। ভেতরে কী হয়, সেটাই সে দেখতে চায়। পানাহি জানতেন, সোলমাজকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হবে না; কারণ সেটার নিয়ম নেই। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা। একপর্যায়ে পানাহি কিছুটা ইতস্তত বোধও করছিলেন। অবশেষে আবদার উপেক্ষা করতে না পেরে মেয়েকে সঙ্গে নিতে হয় তাকে। গাড়ি থেকে স্টেডিয়ামের বাইরে নামে তারা; ঝামেলাটা ঠিকই বাঁধে! কর্তৃপক্ষ পানাহিকে ঢুকতে দিলেও ছোট্টো সোলমাজকে ঢোকার অনুমতি দেয় না। যে ভয় পানাহি আগেই পেয়েছিলেন। মেয়ের বয়স কম বলে তিনি জোরাজুরি করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত পানাহি খানিকটা অনুনয় পর্যন্ত করেন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্তে অটল। অথচ ছোট্টো সোলমাজ বরাবরই বাবাকে তাদের কাছে অনুনয় করতে নিষেধ করছিলো! এর পরে যা ঘটলো তা রীতিমতো অকল্পনীয়। পানাহির ভাষ্যমতেজ্জ

হঠাৎই সে(সোলমাজ) আমাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে বলে, তুমি যাও, আমি দেখছি। ভেতরে যাওয়ার ১০ মিনিট বা তার কিছু পরেই দেখতে পেলাম সেও ভেতরে আসছে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি, কীভাবে তুমি ভেতরে ঢুকলে? সে বলে, সব সময় কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই! আমার মেয়ের এই কথাটাই মূলত আমাকে ভাবিয়েছে। একজন মেয়ে/নারী যদি খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ঢুকতে চায়, তাহলে তাকে কী করতে হবে? এই প্রশ্ন থেকেই মূলত অফসাইড-এর ভাবনাটা শুরু। যদিও ভাবনাটাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে গিয়ে আমাকে নানা বিকল্প পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে।

মেয়ে সোলমাজ যেমন অসাধ্য সাধন করেছিলো, বাবাও কম যান না! ওই যে ‘সব সময় কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই। রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুর অন্তরালে পানাহি নেমে পড়েন অফসাইড-এর নির্মাণ কাজে। প্রথমেই যেটা করেন, চলচ্চিত্রটির মূল চিত্রনাট্যের পরিবর্তে ভিন্ন একটি চিত্রনাট্য জমা দেন সরকারের নির্দিষ্ট দপ্তরে। নির্মাতা হিসেবেও নিজেকে উহ্য রেখে সহকারী মোজতাবা মিরতাহমাসব-এর নাম দেন। শুটিং স্পট ইরান ও বাহরাইন-এর সরাসরি খেলার মাঠ। অযথা লোক জানাজানির ঝুটঝামেলা এড়িয়ে যাওয়াটাই ভালো; কাজেই ব্যবহার করা হলো গোপন ক্যামেরা। অভিনয়শিল্পীরা সবাই অপেশাদার; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কিন্তু গোল বাঁধে শুটিং-এর শেষের দিকে। রাষ্ট্রপক্ষ কীভাবে যেনো জেনে গেছে, অন্য একটি চিত্রনাট্যের শুটিং করা হচ্ছে; বাধ সাধলো মাঝপথে। এখনই শুটিং বন্ধ। বাজেয়াপ্ত করা হবে ফুটেজ। কীভাবে যেনো কৌশলে বেঁচে গেলেন সে যাত্রায়। অতি সতর্কতার সঙ্গে শেষ হলো শুটিং। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে মিললো পুরস্কারও। কিন্তু নিজ দেশ ইরানেই নিষিদ্ধ হলো অফসাইড। অবশ্য পানাহি মোটেও দমে যাবার পাত্র নন। প্রযুক্তির কল্যাণে সর্বত্র ছড়িয়ে গেলো চলচ্চিত্রটির লাখো কপি। বিশ্ববাসী দেখলো বাবা-মেয়ের চিন্তার ফসল অফসাইড।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। পানাহির প্রায় চলচ্চিত্রই কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ভিতকে নাড়া দেয়, প্রশ্নবিদ্ধ করে। যদিও তাকে অফসাইড-এর পর দীর্ঘ সময় কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে দেওয়া হয়নি; তারপরও কেবল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যই ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার-এর অভিযোগ এনে গৃহবন্দি করা হয়। ছয় বছরের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ২০ বছরের জন্য এই সংক্রান্ত সবধরনের কাজ, চিত্রনাট্য, গল্প, নাটক, স্মৃতিকথা এমনকি ডায়েরি লেখা থেকেও নির্বাসিত হন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে পানাহির ভাষ্য এমন-

কারাগারে আমার খানিকটা মানসিক শান্তি ছিলো, কারণ কিছুই করতে পারছিলাম না। কারাগারের গণ্ডিতে রুদ্ধ ছিলাম। আপনি যখন বাইরে থাকেন, কিন্তু কাজ করার অনুমতি থাকে না, তখন তা আরো বিরাট কোনো কারাগারের মতো হয়ে দাঁড়ায়। অবস্থা আর পরিস্থিতি ভিন্ন, কিন্তু কাজের অক্ষমতার কারণে আপনার ভেতর সেই বন্দিত্বের অনুভূতিই কাজ করে।

কিছুই করতে না পারা পানাহির কাছে যেনো কারাগার আর বাইরের মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না; বরং কারাগারকেই অনেক বেশি স্বস্তির জায়গা বলে মনে হয়। নিদেনপক্ষে সেটা তো ‘বাইরের বিরাট কারাগার থেকে শ্রেয়! কিন্তু তারপরও হাল ছাড়েননি পানাহি। কাজ চালিয়ে গেছেন নিভৃতে। গৃহবন্দি হয়েও স্মার্টফোন-এর ক্যামেরায় তুলে এনেছেন নিজের চার দেয়ালে আবদ্ধ জীবনের বন্দিত্বের অনুভূতিকে (দিস ইজ নট এ ফিল্ম,২০১০)। গোপনে তা পেনড্রাইভ-এর মাধ্যমে ছড়িয়েও পড়ে। পানাহি আবারও মেয়ে সোলমাজের সুরে সুর মিলিয়ে প্রমাণ করেন, সত্যিই! ‘সব সময় কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই।

চন্দ্রবিন্দুর ‘বিন্দুর খোঁজে

বিপ্লব-পূর্ব ইরানে মার্কিন মদদপুষ্ট রেজা শাহ পাহলভির স্বৈর-সরকার ছিলো শাসন ক্ষমতায়। যে কারণে, অনেকটা পশ্চিমা ধাঁচেই রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ফলে, নারীর অধিকার কিছুটা সংরক্ষিত ছিলো; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পিতৃতান্ত্রিকতা জারি ছিলো না। অসাম্প্রদায়িক সরকার থাকলেও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা তখনো ছিলো ইরানের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও তখন অসাম্প্রদায়িক আধুনিকীকরণ ও নারীদের প্রতি মোল্লাদের প্রভাব কিছুটা দমন করা হয়। ফলে মোল্লারা ক্ষুব্ধ ছিলো শাহের আচরণে। সাধারণ জনগণও যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তখন তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় বিপ্লবের।

১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ঘটে বিপ্লব। ফুকোর দৃষ্টিতে, এই বিপ্লব হলো জাতির ‘মিলিত ইচ্ছা। তিনি বলেন, ‘“আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা জানি না, তবে আমরা তেহরানে এবং ইরানের সর্বত্র এই মিলিত ইচ্ছার দেখা পেয়েছি।”’ কাজেই ‘মিলিত ইচ্ছা দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে সেটা আলাদাভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে। এক্ষেত্রে দেশটির নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসকেই হয়তো বুঝিয়েছেন ফুকো। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ বিপ্লবে পুরুষের সঙ্গে নারীর গণ-অংশগ্রহণই তা প্রমাণ করে। ফুকো আরো বলেন, ‘“ইরানি মেয়েরা পশ্চিমা ভাবধারায় জীবন যাপন করলেও সমাজের কোথাও বিন্দুমাত্র শান্তি ছিলো না, সব জায়গায় এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজমান ছিলো; ইরানে ইসলামী বিপ্লব ইরানি মেয়েদেরকে এবং গোটা ইরানকে অশান্তির দাবানল থেকে উদ্ধার করেছে।”’

কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে ইরানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। চালু করা হয় ইসলামি শরিয়াহ আইন। যে নারী বিপ্লবে অসামান্য অবদান রেখেছে, তাকেই করা হয় কর্তৃত্বাধীন। ফলে স্বয়ং ফুকো, যিনি বিপ্লবকে সমর্থন দিয়েছিলেন, ‘মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সরকার জনগণের অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে এই মর্মে চরম বিতৃষ্ণা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে নতুন ইরানি প্রধানমন্ত্রী মেহদী বাজারগান কে চিঠি পর্যন্ত পাঠান। বিপ্লব পরবর্তী অবস্থাটা এমন দাঁড়াবে সেটা হয়তো কেউই তখন ভাবতে পারেনি। শিরিন এবাদির ভাষ্যমতে-

সেদিন (বিপ্লবের সময়) আমার চোখে-মুখে গর্বের ছাপ সুস্পষ্ট ছিলো, এখন সেটা ভেবে আমার হাসি পায়। বিপ্লবের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বিজয়ী হয়েছি বলে আমি অনুভব করেছি। মাসখানেকের মধ্যেই আমি বুঝতে পারলাম, নিজের ইচ্ছায় নিজেই আমি আমার কবর খুঁড়েছি। আমি নারী, আর ওই বিপ্লব আমার পরাজয়ই কামনা করেছে।

নারীর ‘বিপ্লবের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বিজয়ী হয়েছি মনোভাবকে পর্যুদস্ত করতে যে খুব বেশি সময় নেয়নি বিপ্লবোত্তর খোমেনি সরকার, ইসলামি শরিয়াহ আইনের বদৌলতে তারা খুব দ্রুতই সেটা টের পায়। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, নারী থাকবে হিজাবের অন্তরালে। গৃহবন্দি। থাকবে না লেখাপড়া ও বাইরে কাজ করার অধিকার। আট বছর বয়স থেকেই মেয়েদের বোরখা বাধ্যতামূলক। শোনা যাবে না মেয়েদের পায়ের শব্দ। গলার স্বর থাকবে নমনীয়, উচ্চস্বরে কথা বলতে পারবে না কোনো নারী।১০ এরকম অসংখ্য ফতোয়া জারি করা হয় নারীর ওপর। কিন্তু আদৌ কি ‘ইসলাম নারীকে এভাবে দেখে? নাকি নারীকে ‘মুক্তির আশ্বাস দেয়? আসমা বারলাস-এর ভাষায়-

বিশ্বাসী হিসেবে আমার কাছে, হাদিসের প্রতিটি বিষয়ের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, কিন্তু কোরআনে যা-আছে সে-ব্যাপারে আমরা একশভাগ নিশ্চিত। অর্থাৎ, এটা এক ধরনের চক্রাকার যুক্তি প্রদান, এই যুক্তিতর্কে যারা সমালোচক তারা সারাক্ষণ পিছলাতে থাকে। যে মুসলমানরা এ ধরনের ইসলামী শরিয়া রক্ষা করেন, তারা কোরআন থেকে হাদিসে সরেন, আর আরো পরে, ইজমাতে। আপনি যখন তাদের পিছু নেন, তাদের বলেন, কোরআন বিভিন্নভাবে পাঠ করা যায়, তারা আশ্রয় নেন হাদিসে। আপনি যখন বলেন হাদিসে অনেকের কণ্ঠস্বর, নানান অর্থ রয়েছে এতে, তারা বলেন, ইজমা এটা মানবে না। যদিও পাবলিক যৌক্তিকতা খোদ নির্মিত। আমি এটাকে ‘নিপীড়নের বৃত্ত বলি, মুসলমান নারীদের পক্ষে এর থেকে মুক্ত হওয়া খুব কঠিন, কারণ তারা [সমালোচকরা] এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে লাফিয়ে বেড়ান।১১

এই ধারাবাহিকতায় ইসলামি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী ইরানে নারীদের হিজাব পরা ‘বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানি নারীরা যে হিজাব বাধ্যতামূলক করার আগে তা পরতো না, বিষয়টা তেমনও নয়। তাহলে কেনো ‘হিজাব বাধ্যতামূলক করা হলো? শরিয়াহ আইনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ‘হিজাব বাধ্যতামূলককে রূপকতার মাধ্যমে গ্রহণ করলে সহজেই বোঝা যাবে। যা ইরানি নারীদের কাছে হয়ে ওঠে বড়ো আশঙ্কার ইঙ্গিতস্বরূপ। যার ফলে তারা প্রথম প্রতিবাদ করে হিজাবের বিরুদ্ধেই। এমনই এক প্রতিবাদকারী ইরানি নারী ভিদা মভায়েদ-এর ভাষ্য এমনজ্জ“‘আমরা এক টুকরো কাপড়ের বিরুদ্ধে লড়ছি না। আমরা আমাদের সম্মানের জন্য লড়াই করছি। আমরা যদি আমাদের মাথার ওপরে কী চড়াবো সেই সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, আমাদের মাথার ভেতরে যা আছে, তার দায় দায়িত্ব নিতেও আমাদের দেওয়া হবে না।’”১২ কাজেই ‘হিজাবের বাধ্যবাধকতা ইরানি নারীদের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরানো তথা ‘নিপীড়নের বৃত্ত ও অত্যাচারের প্রতীক হিসেবেই প্রতিভাত হয়। যা পরবর্তী সময়ে নারীর ওপর নানা বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে আরো পাকাপোক্তই হয়।

অফসাইড-এ ‘অফসাইড

ফুটবল খেলায় বিপক্ষ দলের প্রতিরক্ষা ফাঁড়িকে চ্যালেঞ্জ না করে কোনো খেলোয়াড় যদি বল পাস দেওয়ার আগেই সেখানে ঢুকে পড়ে, তখন সেটা অফসাইডের আওতাভুক্ত হয়। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ দলের ‘ডিফেন্ডারদের বল ছাড়া কোনো খেলোয়াড় অতিক্রম করলেই সেটা অফসাইড। যেহেতু অফসাইড প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে না, অর্থাৎ ডিফেন্ডার যেখানেই অবস্থান করুক না কেনো বল ছাড়া কোনো খেলোয়াড় তাকে অতিক্রম করতে পারবে না। তাই এটা একটা ফাঁদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তার মানে, এই ফাঁদ এড়িয়ে যাবার একমাত্র উপায় হলো বল। বল যতোক্ষণ খেলোয়াড়ের পায়ে থাকে ততোক্ষণ সে এবং তার সহযোদ্ধা খেলোয়াড়রা অফসাইডের ফাঁদ থেকে রেহাই পায়। সমাজেও এমন ফাঁদ বা প্রতিরক্ষা ফাঁড়ি রয়েছে। সেই ফাঁদ বা ফাঁড়ি হলো পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো। সেখানে নারী হয় প্রতিপক্ষ। তাই তাকে সেই ফাঁড়ি চ্যালেঞ্জ করতে হয়। আর বলটা যেনো ক্ষমতারই রূপক। কাজেই ‘বল দখলে থাকলে সব ‘অফসাইডই জায়েজ হয়ে যায়। আর পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে ‘বল যেহেতু পুরুষের পায়ে, তাই ‘বলহীন নারীই প্রতিনিয়ত ‘অফসাইড-এর শিকার হয়ে থাকে। অফসাইড-এর পরতে পরতে এই ধ্বনি-প্রতিধ্বনিই শুনতে পাওয়া যায়।

চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়, বাসে ভ্রমণরত একজন বৃদ্ধকে। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। তিনি তার মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কারণ স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গেছে। চিন্তাটা আরো বেড়ে যায়; কারণ মেয়েদের খেলা দেখতে যাওয়া নিষিদ্ধ। অগত্যা তিনি ছুটে চলেন স্টেডিয়ামের দিকে। বাস চালকের সঙ্গে তার কিছু কথাও হয়। সেই কথোপকথন এমনজ্জ

বাস চালক : আপনার মেয়ে কি সত্যিই খেলা দেখতে গেছে?

বৃদ্ধ : যদি নাই যায়, তাহলে ওর ভাইয়েরা কীভাবে জানতে পারলো! আল্লাহই জানে, খুঁজে পাওয়া গেলে ওর ভাইয়েরা ওকে কী যে করবে! ওরা কিছু করার আগেই যেনো খুঁজে পাই, নইলে ওকে মেরেই ফেলবে।

বাস চালক : খুঁজে পাবেন, চিন্তা করবেন না।

এই কথোপকথন থেকে ইরানের সমাজ-রাষ্ট্র ও পরিবার কাঠামোতে নারীর অবস্থান সম্পর্কে খুব সহজেই অনুমান করা যায়। ‘খুঁজে পাওয়া গেলে ওর ভাইয়েরা ওকে কী যে করবে বা ‘নইলে ওকে মেরেই ফেলবে এই বাক্যাংশগুলো তারই প্রতিচ্ছবি। সেখানে পুরুষ ভাইয়ের খেলা দেখা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাঁধে তখন, যখন নারী খেলা দেখতে যায়। প্রতিরক্ষা ফাঁড়ি হয়ে দাঁড়ায় পুরুষ। সম্প্রতি ইরানের একটি ঘটনা থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়। কেবল মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের জের ধরে ‘পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য বাবা মেয়ের শিরোচ্ছেদ করেন। মৃত্যুর পর শেষকৃত্য আয়োজন করা হয় বটে, কিন্তু তাও ওই বাবার সম্মানেই।১৩ বাবা ও পরিবারের এই কর্মকাণ্ড চলচ্চিত্রে ‘নইলে ওকে মেরেই ফেলবে বা ‘খুঁজে পাওয়া গেলে ওর ভাইয়েরা ওকে কী যে করবে বাক্যাংশের মাধ্যমে জেঁকে বসা যে পিতৃতন্ত্রের ইঙ্গিত দেওয়া হয় তারই সমর্থন জোগায়। কিন্তু নারী তবুও পুরুষের প্রতিরক্ষা ফাঁড়ি তথা পিতৃতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে ভেতরে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। ‘বল যেহেতু নেই কাজেই ‘ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টার ফলস্বরূপ নারীকে পড়তে হয় ‘অফসাইড-এর কবলে।

চলচ্চিত্রের চার মিনিট ৫০ সেকেন্ডের দৃশ্যে দেখা যায়, পুরুষের ছদ্মবেশে এক নারী বাসে চড়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাচ্ছে। বাসের সবাই পুরুষ। হঠাৎই এক পুরুষের নজরে পড়ে মেয়েটি। পুরুষটি আসলে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে মেয়েটি এভাবে আসতে পারে! সে বার বার মেয়েটির দিকে বিস্ময়ে তাকাচ্ছিলো। তখন মেয়েটি বিরক্ত হয়ে তাকে সাবধান করে বলেন-

মেয়ে ১ : আপনি কেনো আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন? তাকানো বন্ধ করুন, তা নাহলে ওরা আমাকে ধরে ফেলবে। আপনি আমার পরিকল্পনাটাই ভেস্তে দেবেন দেখছি।

ছেলে : চিন্তা করবেন না। কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

মেয়ে ১ : হিরো হওয়ার অভিনয় বন্ধ করুন। আমি জানি, কীভাবে স্টেডিয়ামে ঢুকতে হবে।

নারীর দিকে পুরুষের ‘বিস্ময়ে তাকানো যেনো তৈরি করা ‘অফসাইড নামক ফাঁদেরই ইঙ্গিত। এর মাধ্যমে নারীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়, তোমার কাছে ‘বল নেই; চ্যালেঞ্জ করা মানেই পড়তে হবে অফসাইডের ফাঁদে। কিন্তু ‘আমি জানি, কীভাবে স্টেডিয়ামে ঢুকতে হয় যেনো নারীর সেই ফাঁদ উতরে যাওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে।

আবার ১১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে মেয়েটিকে কালোবাজারির কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে দেখা যায়। নারী হয়েও খেলা দেখতে আসায় তাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকেন ওই টিকিট বিক্রেতা। তিনি কোনো নারীর কাছে টিকিট বিক্রি করতে নারাজ। অথচ মেয়েটি নাছোড়বান্দা; টিকিট সে নেবেই। এই সুযোগে পোস্টারসহ টিকিটের মূল্য আট হাজার পাঁচশত তোমান চেয়ে বসেন বিক্রেতা; অথচ একটু আগেই একজন পুরুষ পাঁচ হাজার তোমানে একই টিকিট সংগ্রহ করেন। মেয়েটিকে বাধ্য হয়েই টিকিটটা কিনতে হয়, কারণ তিনি তো নিজেই এখানে ‘নিষিদ্ধ। কাজেই প্রতিবাদের কিছুই থাকে না। টিকিট বিক্রেতা পুরুষের কাছে কম ও নারীর কাছে বেশি দামে টিকিট বিক্রির মাধ্যম হয়ে ওঠে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থারই প্রতিভু, তারা বসে আছে ‘অফসাইড-এর পসরা সাজিয়ে।

যাহোক, টিকিট সংগ্রহ করে মেয়েটি স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকতে গেলে সৈন্যরা তাকে আটকায়। মেয়েটি দৌড়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতে। তখন এক সৈন্যকে বলতে শোনা যায়-

সৈন্য : এখানে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। আপনাকে ঢুকতে দিলো কে? ওকে ধরো (দৌড়ে পালানোর সময়) ...। থামুন বলছি! অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকলেন কেনো?

এখানেও নারী ‘অফসাইড-এর ফাঁদ থেকে রেহাই পায় না; কারণ ‘বল যে তার পায়ে নেই। সেটা পুরুষের পায়ে। যার দরুন, সৈন্যরা পুরুষের ভেতরে ঢোকা নিয়ে প্রশ্ন করছে না। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নারী। এভাবেই পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে নারী প্রতিনিয়ত ‘বলহীন হয়ে বলের মতো পুরুষের পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। আর পুরুষ তাকে যথেচ্ছা পরিচালিত করে; প্রতিবাদ করলেই শিকার হতে হয় অফসাইডের।

‘দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা

সৈন্যরা মেয়েটিকে স্টেডিয়ামের গ্যালারির বাইরে একটি জায়গায় আটক করে রাখে। সেখানে কেবল সে একা নয়, আরো তিনটি মেয়েও রয়েছে। এরপর আরো দুইজন যুক্ত হয়। চলচ্চিত্রের ২৫ মিনিট ২০ সেকেন্ডে দেখা যায়, এ পর্যন্ত আটক করা সর্বশেষ মেয়েটি (এরপর আরো একজনকে ধরে আনা হয়) সিগারেট জ্বালাচ্ছে। দায়িত্বে থাকা সৈন্যদের মধ্যে একজন তখন বলে ওঠেন-

সৈন্য : এই, সিগারেট ফেলো বলছি।

মেয়ে ৫ : ধুমপান করা অপরাধ নাকি?

সৈন্য : আপনি এখানে ধুমপান করতে পারবেন না। বাড়িতে গিয়ে ধুমপান করুন।

মেয়ে ৫ : বাড়িতে গিয়েই করবো। সেটা আপনাকে বলতে হবে না।

এই কথা বলে মেয়েটি সৈন্যের কথায় কান না দিয়ে সিগারেট টানতে থাকে। তখন অন্য একটি মেয়ে ২২ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে এক সৈন্যের সিগারেট জ্বালানোর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘অন্যরা তো বাইরেই এটা করতে পারে, তাহলে আমরা কেনো পারবো না?’

এই কথোপকথন থেকে বোঝা যায়, নারী মোটেও ছেড়ে কথা বলবার পাত্র নয়; সে প্রতিবাদ করতে জানে। মেয়েটির হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটের আগুন যেনো হয়ে ওঠে পুরুষ প্রাধান্যশীল রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নারীর দীর্ঘ দিনের জমে থাকা চাপা ক্ষোভ ও প্রতিবাদেরই প্রতীক। ধোঁয়া যেনো সেই ক্ষোভ ও প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ; যা সব প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে বেরিয়ে আসছে। আর নারী যখন বলে ওঠে, ‘বাড়িতে গিয়েই করবো বা ‘সেটা আপনাকে বলতে হবে না তখন সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

চলচ্চিত্রের ২৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের দৃশ্যে দেখা যায়, সিগারেট জ্বালানো মেয়েটি একজন সৈন্যের সঙ্গে তর্ক করছেন। তর্কটা এমনজ্জ

সৈন্য : দেখো, তুমি আমাকে ওই গেঁয়ো ছেলেটার মতো সহজে ভুলাতে পারবে না (একজন সৈন্যের দিকে ইশারা করে)। এমন মারা মারবো যে ভুলতে পারবে না।

সৈনিকের এই কথায় মেয়েটি মুখে হাত রেখে ফুঁ দিয়ে এক ধরনের আওয়াজ করে। মেয়ের এমন আওয়াজ ও অঙ্গভঙ্গি দেখে সৈনিকটি তাকে মারতে উদ্যত হয়। তখন অন্য একজন সৈন্য তাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বলে ওঠেন, ‘ছাড়ো আমাকে। ও আমাকে তেজ দেখাচ্ছে!’ সৈন্যের এই আচরণের উত্তরে নারীর ওই প্রতিবাদ তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়। বলে দেয় নারীর ওপর কোনো কিছুই চাপানো সহজ হবে না।

চলচ্চিত্রের ৩২ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডে আটক মেয়েদের মধ্যে একজন টয়লেট-এ যেতে চায়। কিন্তু স্টেডিয়ামে নারীদের জন্য কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। মেয়েটি পুরুষের টয়লেটেই যেতে চাইলে সৈন্যরা তাকে বাধা দেয়। একজন বলে ওঠেনজ্জ

সৈন্য : তোমাদের মাথায় শয়তান চেপে বসেছে নাকি? একজন সৈনিক হতে চাচ্ছে (আটককৃত নারীদের মধ্যে একজনের দিকে ইশারা করে), আরেকজন চাচ্ছে পুরুষের টয়লেটে যেতে!

মেয়ে ৪ : আপনারা যদি আমাকে যেতে না দেন, তবে আমি কিন্তু এখানেই প্রসাব করে দিবো!

মেয়ে ৫ : সাবাস! সাহসী মেয়ে!

এখানেও নারীর পরিষ্কার অবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। মেয়েটি যখন বলেন, ‘আমি কিন্তু এখানেই প্রসাব করে দিবো তখন নারীর প্রতিবাদী সত্তার সন্ধান আমরা পাই। আবার এক মেয়ে যখন অন্য মেয়েকে সাহস জুগিয়ে বলেন, ‘সাবাস! সাহসী মেয়ে তখন নারীর মধ্যে একতাবদ্ধ প্রতিবাদী চেতনার অনুরণনই পরিলক্ষিত হয়। পরিষ্কার হয়ে যায়, নারী তার চলার পথ নিজেই ‘মসৃণ করে নিতে জানে বা ‘মসৃণ করে নিতে হয়।

আবার চলচ্চিত্রের ৪৭ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে একজন সৈন্যের সঙ্গে একজন মেয়েকে কথা বলতে দেখা যায়। মেয়েটি সৈন্যকে প্রশ্ন করছেন এভাবে-

মেয়ে ৫ : কেনো নারীরা স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারবে না? কেনোইবা পুরুষের পাশে বসতে পারবে না?

সৈন্য : আপনি এতো জেদি কেনো? নারীরা স্টেডিয়ামে পুরুষের পাশে বসতে পারে না।

মেয়ে ৫ : তাহলে জাপানি নারীরা কেনো জাপান-ইরান খেলায় এই স্টেডিয়ামে পুরুষের পাশে বসতে পারবে!

সৈন্য : তারা জাপানি তাই।

মেয়ে ৫ : ও আচ্ছা, তাহলে মূল সমস্যা ইরানে জন্মগ্রহণ করাটা? আমরা যদি জাপানে জন্মগ্রহণ করতাম, তাহলে খেলা দেখা জায়েজ হতো, না?

সৈন্য : তারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না। লোকেরা যদি গালি বা কটু কথা বলে তাহলে তারা বুঝতে পারবে না।

মেয়ে ৫ : তাহলে সমস্যাটা গালি বা কটু কথা?

সৈন্য : না, তেমনটা নয়। নারী ও পুরুষ একসঙ্গে বসতে পারে না।

নারীর ‘ন্যায্য অধিকার হরণের পেছনে মূল কারণ যে পুরুষ প্রাধান্যশীল রাষ্ট্রকাঠামো সেটাই নারীর উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে উঠে আসে। ‘কেনো নারীরা স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারবে না বা ‘কেনোইবা পুরুষের পাশে বসতে পারবে না-এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈন্যটি যখন বলেন, ‘নারী ও পুরুষ একসঙ্গে বসতে পারে না তখন আসলে সেটা রাষ্ট্রের পুরুষবাদী আচরণের দিকেই সরাসরি ইঙ্গিত করে। আবার নারী যখন প্রশ্ন তোলে, ‘জাপানি নারীরা কেনো জাপান-ইরান খেলায় এই স্টেডিয়ামে পুরুষের পাশে বসতে পারবে বা ‘তাহলে আমাদের মূল সমস্যা ইরানে জন্মগ্রহণ করাটা?’, তখন পুরুষ প্রাধান্যশীল রাষ্ট্র ‘জাতীয়তাবাদ নামক যে ‘শোষণ-যন্ত্র ও ধর্মকে ব্যবহারের মাধ্যমে নারীকে বন্দি রাখতে চায় বা করে সেটা পরিষ্কার হয়। সৈন্যটি যখন বলেন, ‘তারা জাপানি বা ‘তারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না তাই তাদের খেলা দেখতে দেওয়া হচ্ছে, তখন ‘জাতীয়তাবাদ-এর ভয়ঙ্কর রূপটি ধরা পড়ে। কিন্তু নারী যখন বলে বসে, ‘জাপানের নারীরা খেলা দেখতে পারলে ইরানের নারীরা কেনো পারবে না তখন খোদ ‘জাতীয়তাবাদ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। আর এই প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে নারী তার অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়।

সামরিক বাহিনীতেই ‘সামরিকতা

বিপ্লব-পূর্ব ইরানের যে সেনাবাহিনী তার নাম ছিলো আরতেশ (Artesh)। এই বাহিনীই মূলত সেই সময়ে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সব ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করতো। কিন্তু বিপ্লব চলাকালীন সংঘবদ্ধ বিপ্লবী তরুণদের নিয়ে গঠন করা হয় ইসলামিক রিভ্যলুশনারি গার্ড কর্পস (আই আর জি সি)। যা পাসদারান (Pasdaran) নামে পরিচিতি পায়। মূলত খোমেনিকে সমর্থনের মাধ্যমে তারা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে খোমেনি সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ এপ্রিল আই আর জি সিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

খোমেনির নির্দেশেই আরতেশ ও পাসদারানকে বাহিনী হিসেবে আলাদা রাখা হয়। তবে কৌশলগত কারণে ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় পাসদারান বা আই আর জি সির। এই বাহিনী যেহেতু খোমেনির নির্দেশেই প্রতিষ্ঠিত ও সদস্যদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল, ফলে প্রধান ধর্মীয় নেতা হিসেবে খোমেনির কাছেই সামরিক ক্ষমতা অনেকখানি কেন্দ্রীভূত হয়। যার প্রভাব পরবর্তী সময়ে ইরানের সংবিধানেও পড়ে। ইরানি সংবিধান অনুযায়ী, আরতেশ-এর কাজ সীমানা সুরক্ষা এবং আই আর জি সির কাজ ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করা। অর্থ আর সামরিক শক্তিতে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা আই আর জি সির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে ক্ষমতা কাঠামোতেও।১৪ ফলে ক্রমশই বাহিনীটি ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে একটি বিরাট শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

এই বাস্তবতায় আরতেশ-এর ওপর পরোক্ষ, কখনো কখনো প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে আই আর জি সির। আবার ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের পহেলা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত ইরানের পুলিশ বাহিনী নাজাও (ঘধলধ) আই আর জি সি দ্বারা প্রভাবিত। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের নিয়ে গড়ে ওঠা বাসিজ (ইধংরল) নামের মিলিশিয়া বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করে আই আর জি সি।১৫ যার দরুন, আই আর জি সির নির্দেশনা অনুযায়ীই নিয়মিত সামরিক ইউনিট মোতায়েনসহ খোমেনির শাসনের সমর্থনে পুলিশি ও নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিন্তু বয়সসীমা ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে থাকা আই আর জি সির অধিকাংশ সদস্যই ইরানের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দারিদ্রসীমার নিচ থেকে উঠে আসা।১৬ কাজেই একদিকে অর্থনৈতিক দৈন্য ও টানাপড়েন, অন্যদিকে ধর্মীয় অনুভূতি; সব মিলিয়ে তারা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে একরকম বাধ্য হয়। তাদের এই অর্থনৈতিক দৈন্য ও ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। ফলে সাধারণ সৈনিকদেরও পড়তে হয় শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা কর্তৃত্ববাদী গ্যাঁড়াকলে। চলচ্চিত্রের ২৭ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডের দৃশ্যে তা যেনো আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে একজন সৈন্য একজন আটক মেয়ের সঙ্গে কথা বলছেন এভাবে-

সৈন্য : তোমরা আমার সময় নষ্ট করছো। আমি এখন গ্রামে আমার আবাদি জমি ও পশু দেখাশোনা করতাম। আমার মা অসুস্থ তাই সে এগুলোর যত্ন নিতে পারছে না। জমি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ফসলগুলো মারা যাচ্ছে।

মেয়ে ৪: আমি বুঝতে পারছি আপনার দুঃখটা!

আবার চলচ্চিত্রের প্রায় অনেক দৃশ্যে মেয়েদের প্রশ্নের উত্তরে সৈন্যটিকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বস নই বা ‘শাস্তি পেতে হবে

কাজেই কথোপকথন থেকে এটা স্পষ্ট যে, সৈন্যদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। যখন ওই সৈন্য বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ তাই সে ফসলের যত্ন নিতে পারছে না তখন অনুমান করে নেওয়াই যায় তার বাবা বেঁচে নেই। সেই পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি ও পরিবারটির অর্থনৈতিক অবস্থাও নাজুক। আবার যখন তিনি বলেন, ‘আমি বস নই বা ‘শাস্তি পেতে হবে তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে যারা থাকে তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা কর্তৃত্বের বেড়াজালে আটকে থাকতে হয় তার মতো অনেককেই। সৈন্যটির, ‘আমি এখন গ্রামে আমার আবাদি জমি ও পশুর দেখাশোনা করতাম এই কথা থেকেও বুঝতে বাকি থাকে না, শাসকশ্রেণি তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করছে।

আবার চলচ্চিত্রের ৫২ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের দৃশ্যে দুজন সৈন্যের মধ্যে কথা বলতে দেখা যায়। কথোপকথন এমনজ্জ

সৈন্য ১ : এদের মধ্যে (মেয়েগুলো) একজনকে যদি আমরা হারিয়ে ফেলি তাহলে কী হবে?

সৈন্য ২ : বিপাকে পড়বো আমরা। আজীবন সেনাবাহিনীতেই আটকে থাকতে হবে।

এই কথোপকথন থেকে শাসকের ফ্যাসিবাদী চরিত্র ও তার ভয়ঙ্কর চিত্রটি ফুটে ওঠে। দ্বিতীয় সৈন্যটি যখন বলেন, ‘আজীবন সেনাবাহিনীতেই আটকে থাকতে হবে, তখন পরিষ্কার হয় যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন তারা ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। আর তাদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও ধর্ম হয়ে ওঠে প্রধান নিয়ামক। যার দোহাই দিয়ে শাসকগোষ্ঠী শোষণ অব্যাহত রাখে।

এছাড়া চলচ্চিত্রের ৫৭ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডের দৃশ্যে আটক এক মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় সৈন্যরা চিফ-এর কাছে কী জবাব দেবে এই দুশ্চিন্তা করতে থাকে। এসময় তাদের কথোপকথন ছিলো এমনজ্জ

সৈন্য ৩ : আমি সত্য কথা বলবো। আমরা তালিকায় পলাতক কয়েদির নাম দিতেও হেরফের করিনি।

সৈন্য ১ : আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো, মেয়েগুলো কয়েদি নয়। আমরা তাদের বন্দি করিনি। অন্য কেউ তাদের কারাগারে পাঠাবে। আমরা তাদের বাবা-ভাই-স্বামীর মতো।

এখানে প্রথম সৈন্যের ‘আমরা তাদের বাবা-ভাই-স্বামীর মতো কথায় বোঝা যায়, তারাও নিজেদের সাধারণ জণগণের একজন হিসেবেই একাত্মতা ঘোষণা করে; এবং কর্তৃত্ব বজায় রাখা তাদের কাজ নয় ও জোরপূর্বক সেটা করানোর ক্ষেত্রে তারা ব্যবহৃত হয়। আবার যখন তিনি বলেন, ‘অন্য কেউ তাদের কারাগারে পাঠাবে তখন বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিষ্কার হয় যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকে তারাই এর মূল হোতা। সৈন্যরা ব্যবহৃত হয় মাত্র। [পরিপূরক হিসেবে দেখে নেওয়া যেতে পারে ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ-এর নির্মিত চলচ্চিত্র (দেয়ার ইজ নো ইভিল, ২০২০)]

‘নিষিদ্ধই যেনো ‘সিদ্ধ বয়ান

আটক মেয়েদের বাসে করে ‘ভাইস-স্কোয়াড-এ নিয়ে যাওয়ার সময় চলচ্চিত্রের এক ঘণ্টা ২৮ মিনিটের দৃশ্যে দেখা যায়, ইরান খেলায় জয়লাভ করায় জনগণ রাস্তায় নেমে বিজয় উদযাপন করছে। রাস্তায় ভিড় হওয়ায় বাস আর সামনে এগোতে পারে না। সৈন্যরা বাস থেকে নামতে না চাইলেও জনগণ অনেকটা জোর করেই তাদের নামিয়ে নেয়। পরে সৈন্যরাও সাধারণ জনগণের সঙ্গে বিজয় উদযাপন করতে থাকে। মেয়েরা এই ফাঁকে বাস থেকে নেমে যে যার রাস্তা ধরে। একটি মেয়ে আতশবাজি হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।

এই দৃশ্যে ‘ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া নারীকে যে শত বাধাবিঘ্ন পেরিয়েই সামনে এগোতে হয় এবং নারী সেটা করে বা করতে পারে সেটাই স্পষ্ট করে। কাজেই তাকে ‘নিষিদ্ধ করেও কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না রাষ্ট্রের। নারী তার প্রাপ্যটুকু আদায় করে নেয় বা নেওয়ার চেষ্টা জারি রাখে। সে যখন ‘বাস থেকে নেমে রাস্তা ধরে বা ‘আতশবাজি জ্বালিয়ে হাঁটতে থাকে তখন সেটাকে নারীর সেই ‘নিষিদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করে ‘নিপীড়নের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসা ও ‘মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়াই মনে হয়। আর এই ‘মনে হওয়াকে বাস্তবেই রূপ দেয় ইরানি নারীরা। অফসাইড দেখার পর (যদিও ইরানে নিষিদ্ধ) দেশটির নারীরা বেশ সাড়া দেয়। তারা তাদের নানা অধিকার নিয়ে কথা বলতে থাকে। ক্রমাগত কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্নও তোলে। বিষয়টা পানাহি বর্ণনা করেন এভাবে-

অফসাইড চলচ্চিত্রটি দেখার পর ইরানের নারীরা স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার দাবি জানিয়ে এক লাখ ৪০ হাজার স্বাক্ষরসহ ফিফার কাছে চিঠি লেখে। ইরান-কোস্টারিকা ফুটবল ম্যাচে নারীরা সাদা হিজাব পরে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার সময় তাদের হাতে থাকা সাইনবোর্ডে ব্যবহার করে অফসাইড চলচ্চিত্রের শিরোনাম। তাতে লেখা ‘আমরা অফসাইড হতে চাই না। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় টিভিতে খেলা দেখে নারীরা প্রতিবাদ জানায়।১৭

মূলত ‘সাদা হিজাবকে ইরানি নারীরা ‘হিজাব বাধ্যতামূলক আইন-এর বিরুদ্ধে একরকম প্রতিবাদ হিসেবেই ব্যবহার করে। পরবর্তী সময়ে ইরানি নারীদের যেকোনো প্রতিবাদে ‘সাদা হিজাব পরতে দেখা যায়। তার মানে ‘সাদা হিজাব কেবল সাদা হিজাবেই আবদ্ধ থাকে না বরং হয়ে ওঠে নারীর অধিকার আদায়ে প্রতিবাদের প্রতীক। পাশাপাশি অফসাইডও হয়ে ওঠে নারীর ‘অবদমিত বাসনা প্রকাশের মাধ্যম, প্রতিবাদ।

প্রতিবাদের ইতিটা পানাহি এখানেই টানেননি। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারিত জাতীয় সঙ্গীত ব্যবহার করে প্রতিবাদকে করেছেন আরো শাণিত। ‘বাতিল করা এই জাতীয় সঙ্গীতটিকে তিনি ব্যবহার করেছেন রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই। কোনো রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতে স্বভাবতই সংস্কৃতি, সাধারণ জনগণের ইচ্ছা, আকাক্সক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে; হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের রিপ্রেজেন্টেশন। ইরানের জাতীয় সঙ্গীতও নিশ্চয় ইরানি ‘জাতীয়তাবাদ-এর কথাই বলে। অবশ্য ইরানের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে গেলে এর ইতিহাস নিয়ে কথা বলাটা জরুরি। এ পর্যন্ত চার বার পরিবর্তিত হয়েছে দেশটির জাতীয় সঙ্গীত। প্রথম জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ হয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মোজাফ্ফার শাহ আল-দিন কাজার-এর শাসনামলে; এর পর ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পাহলবি শাসনামলে দ্বিতীয়বার ও ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবের পরে তৃতীয়বারের মতো তা পরিবর্তিত হয়। সর্বশেষ পরিবর্তিত হয় ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রধান ধর্মীয় নেতা রুহুলুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর পরই।১৮ তার মানে যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মতাদর্শ, ভাবাদর্শ অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারিত হয়েছে। তৃতীয় জাতীয় সঙ্গীতটি যেহেতু ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত; কাজেই ইরানের জনগণ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিপ্লবে অংশগ্রহণ বা বিপ্লবকে সফল করেছিলো তারই প্রতিফলন হিসেবে এটিকে ধরে নেওয়া যায়। পানাহির বক্তব্যেও তেমনটাই পাওয়া যায়। তার ভাষ্যানুযায়ী-

এই গানে কোনো অ-ফারসি শব্দ নেই। আমাদের দেশের গানগুলো মূলত কোনো সরকার ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে রচিত। অথচ এই গান কোনো সরকার ব্যবস্থার কথা বলে না বরং বলে মানুষ, সংস্কৃতি এবং দেশের কথা। ঐ অবস্থা (বিপ্লব-পূর্ব পরিস্থিতি) থেকে পরিত্রাণ পেতে গানটি রেনেসাঁ হিসেবে কাজ করেছে।১৯

তার মানে ইরানের জনগণের ‘মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ ও ইরানি সমাজে রেনেসাঁর উপাদান ছিলো এই সঙ্গীতে। কিন্তু ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সেটাকেও বদলে ফেলা হলো। এমন হতে পারে, এটা হয়তো সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণেরই ফল; যেখানে জনগণের সেই ‘মিলিত ইচ্ছার মৃত্যু ঘটে। যদিও সেটা অনেক আগেই ঘটে; একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকে না। পানাহি ’৭৯-এর সেই জাতীয় সঙ্গীতটিই ব্যবহার করেন চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে। সেখানে একটি মেয়ে আতশবাজি হাতে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে আবহে তা শুনতে পাওয়া যায়জ্জওহ ইরান, তুমি রত্ন ভরা দেশ/ তোমার মাটি শিল্পের উর্বর ভূমি/ তোমার থেকে দুষ্ট-চিন্তা দূরে থাকুক/ তুমি চিরস্থায়ী হও। নারীর আতশবাজি হাতে সামনে এগোনোর সময় বেজে ওঠা এই সঙ্গীত হয়ে ওঠে জনগণের একাত্মতার প্রতীক ও শাসকের স্বৈর-মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ওই নারী যখন আতশবাজি হাতে হেঁটে যায়, তখন তিনি কেবল ‘নারী থাকে না, হয়ে ওঠে সমস্ত ইরানি জনগণেরই প্রতীক। এছাড়া চলচ্চিত্রজুড়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের যে চিত্র ফুটে ওঠে; তার বিরুদ্ধে আপত্তি তোলে এই গান। ক্ষমতায় যারা থাকে তারা ‘দুষ্ট-চিন্তার মাধ্যমে ইরান ও তার সংস্কৃতিকে কলুষিত করে; কাজেই চলচ্চিত্রে এই জাতীয় সঙ্গীতটি ইরানের ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে যারা থাকে, তাদের দ্বারা সাধারণ জনগণের অধিকার হরণ ও তাদের ‘দুষ্ট-চিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

উপসংহার

পানাহি একবার তার চলচ্চিত্র নিয়ে বলেছিলেন, “‘আমি কোনো রাজনীতিবিদ নই। রাজনৈতিক বিষয় উপস্থাপন বা রাজনীতির সঙ্গে যুদ্ধ করা আমার কাজ নয়। আমার কাছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষের অধিকার। সেজন্য আমি লড়বই এবং তা চলচ্চিত্র দিয়ে।’”২০ পানাহি যতো বিনয়ী হয়েই কথাগুলো বলেন না কেনো, তিনি যা বলেছেন সেটাই তো আসল ‘রাজনীতি। তিনি মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন, আর এই বলার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকে। এই ‘করণ-কারণ ও ‘লড়বোই মনোভাবের জন্য তাকে কম ভোগান্তিও পোহাতে হয়নি। বার বার নিষিদ্ধ হয়েছেন তিনি এবং তার চলচ্চিত্র; নির্মাতা হিসেবে বার বারই রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোতে হয়েছেন ‘অফসাইড। কিন্তু তাতেও শাসকগোষ্ঠী দমাতে পারেনি তাকে। অফসাইড পানাহির ওই ‘করণ-কারণ ও ‘লড়বোই মনোভাবের এক ক্ষুদ্র প্রকাশ। নারী থাকবে পুরুষের করায়ত্বে-পুরুষ প্রাধান্যশীল পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামোর বেঁধে দেওয়া আইনের বাইরে যেতে পারবে না-এমন ডিসকোর্সগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে চলচ্চিত্রটি দরাজ কণ্ঠে আওয়াজ তোলে। নারী যে ‘অফসাইড হয়েও ‘বল নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তারই সেলুলয়েডিয় উপস্থাপন হয়ে ওঠে অফসাইড চলচ্চিত্রটি। ফলে অফসাইড রাষ্ট্রের কাছে ‘অফসাইডই বটে। কিন্তু প্রথাগত সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোতে ‘অফসাইড হয়ে জাফর পানাহি ও অফসাইড মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন অফসাইড মানেই মনে হয় পানাহি আর পানাহি মানেই অফসাইড।

লেখক : মাহমুদুল হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সেমিস্টার-এর শিক্ষার্থী।

hasanalmahmud60@gmail.com

https://www.facebook.com/mahmud.alhasan.14418

 

তথ্যসূত্র

১. ছফা, আহমদ (২০১০ : ১৫); ‘আমাদের সময়; আহমদ ছফার কবিতা সমগ্র; খান ব্রাদারস অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা।

২. বারলাস, আসমা (২০০৬ : ২২১-২২২); ‘কোরআন এবং মুসলমান নারী : পিতৃতন্ত্রের পাঠ, মুক্তির পাঠ, “বিলিভিং উইমেন ইন ইসলাম (অংশ)’; ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন : সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম; অনুবাদ: রেহনুমা আহমেদ; একুশে প্রকাশনী, ঢাকা।

৩. https://youtu.be/Xy8mj4EjHjw; retrieved on : 05.10.2021

৪. https://www.prothomalo.com/entertainment/জাফর-পানাহি-এক-নির্ভীক-চলচ্চিত্রকার; retrieved on: 10.10.2021

৫. ‘কারাগারে কিছুটা মানসিক শান্তি ছিলো আমার : জাফর পানাহি; সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : বাদিন রি জোভ; বণিকবার্তার শুক্রবারের বিশেষ সাময়িকী ‘সিল্করুট; সংখ্যা: ৩৭৪; ৩ মে ২০১৯।

৬. খান, সলিমুল্লাহ (২০০৭ : ২০৭); ‘ইরান ও ইসলাম : মিশেল ফুকো বোধিনী; মিশেল ফুকো পাঠ ও বিবেচনা; সম্পাদনা : পারভেজ হোসেন; সংবেদ প্রকাশনা, ঢাকা।

৭. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ইরানে_নারী; retrieved on: 15.10.2021

৮. রী, জোনাথন (২০০৭ : ২৯০); ‘ফুকোর মনন ও ইরানে সাংবাদিকতা-পর্ব; মিশেল ফুকো পাঠ ও বিবেচনা; অনুবাদ : ফরীদুল আলম; সম্পাদনা: পারভেজ হোসেন; সংবেদ প্রকাশনা, ঢাকা।

৯. এবাদি, শিরিন ( ২০০৭ : ৪৭); ‘ন্যায় বিচারের সন্ধানে; জেগে উঠছে ইরান; অনুবাদ: অবনি অনার্য; সন্দেশ প্রকাশনী, ঢাকা।

১০. https://tv9bangla.com/photo-gallery/what-is-sharia-law-403386-4.html; retrieved on: 20.10.2021

১১. বারলাস, আসমা (২০০৬ : ২১৬); ‘নিপীড়নের বৃত্ত থেকে নারীকে বেরিয়ে আসতে হবে, নভ্রিয়ন্তোনি, রামি এল-দারদিরি, জারিঙ্গান ইসলাম লিবারেল; ইসলামী চিন্তার পুনর্পঠন : সমকালীন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম; অনুবাদ: রেহনুমা আহমেদ; একুশে প্রকাশনী, ঢাকা।

১২. https://www.banglatribune.com/290055/ইরানি-মেয়েদের-হিজাববিরোধী-আন্দোলনের-নেপথ্যে; retrieved on: 25.10.2021

১৩. https://www.dw.com/bn/পিতার-হাতে-কিশোরী-হত্যা-নিয়ে-ইরানে-তুলকালাম/a-53667765; retrieved on: 30.10.2021

১৪. https://roar.media/bangla/main/history/militia-sate-sponsored-armed-force-iran/amp; retrieved on: 05.11.2021

১৫. https://www.bbc.com/bengali/news-42530762; retrieved on: 10.11.2021

১৬. Schahgaldian, Nicola B. and Gina Barkhordarian (1987 : vi); `SUMMARY’; The Iranian Military Under the Islamic Republic; The RAND Corporation, Santa Monica, US.

১৭. https://youtu.be/gP7r4nVTuhI; retrieved on: 20.11.2021

১৮. https://bn.m.wikipedia.org/wiki/ইরানের_জাতীয়_সঙ্গীত; retrieved on: 25.11.2021

১৯. https://youtu.be/iQogfOQfTGM; retrieved on: 30.11.2021

২০. https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/kawser_Rhuso/29408715; retrieved on: 07.12.2021

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন